গাজা উপত্যকায় মানবিক সহায়তা নিতে আসা নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গুলি করে হত্যার স্বীকারোক্তি দিয়েছেন ইসরায়েলি সেনারা। শুক্রবার ইসরায়েলের হারেৎজ পত্রিকায় ওই খবর প্রকাশ করা হয়।
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে সেনা সদস্যরা জানিয়েছেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সরাসরি নির্দেশে তারা এসব গুলি চালিয়েছেন—এটা জানার পরেও যে এসব মানুষ কোনো হুমকি সৃষ্টি করছিল না।
একজন সেনা বলেন, “যেখানে আমি মোতায়েন ছিলাম, প্রতিদিন এক থেকে পাঁচজন মানুষকে হত্যা করা হতো।
জায়গাটা ছিল একপ্রকার ‘মৃত্যুকূপ’। তাদের শত্রু হিসেবে দেখা হয়। সেখানে না থাকে কোনো ভিড় নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা, না থাকে টিয়ার গ্যাস। শুধু গুলি, ভারী মেশিনগান, গ্রেনেড লঞ্চার, মর্টার—যা কিছু কল্পনা করা যায় সবই ব্যবহার করা হয়।
’
হারেৎজ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, মে মাসের শেষদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সমর্থিত বিতর্কিত মানবিক সংস্থা গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) গাজায় চারটি নির্দিষ্ট স্থানে সীমিত খাবার বিতরণ শুরু করে। এই কেন্দ্রগুলো প্রতিদিন মাত্র এক ঘণ্টা করে খোলা থাকে। কিন্তু এর আগেই যারা লাইনে দাঁড়াতে চেষ্টা করতে বা সময় শেষ হওয়ার পর যেতেন, তাদের ওপরও গুলি চালানো হতো।
এক সেনা বলেন, ‘ত্রাণকেন্দ্র খোলার আগে গুলি চালাই যেন কেউ এগিয়ে না আসে, আবার বন্ধ হওয়ার পর গুলি করি যেন তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
আমাদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম—গুলি।’
তিনি আরো বলেন, ‘সকালে কেউ যদি দূর থেকে লাইনে ঢুকতে চায়, বা কাছাকাছি এলে, কোনো হুমকি না থাকলেও আমরা অনেক সময় তাদের ওপর হামলা করি।’ একজন সেনা দাবি করেন, ‘আমি কখনোই পাল্টা গুলির মুখে পড়িনি। এখানে কোনো শত্রু নেই, অস্ত্রধারী কেউ নেই।’
‘অপারেশন সল্টেড ফিশ’—শিশুদের খেলার নামে গণহত্যা
এই সেনা দাবি করেন, যেখানে তিনি নিযুক্ত ছিলেন সেখানে এই অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন সল্টেড ফিশ’, যা ইসরায়েলি শিশুদের একটি খেলার নাম।
একটি নির্মম বাস্তবতাকে অবজ্ঞাসূচকভাবে শিশুদের খেলায় রূপান্তর করা হয়েছে। ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে কমপক্ষে ৫৫০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে এবং ৪ হাজারের বেশি আহত হয়েছে। তারা সবাই সহায়তা নিতে গিয়েছিল।
যুদ্ধাপরাধ তদন্তের ঘোষণা
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ তদন্ত সংস্থা জেনারেল স্টাফ ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং অ্যাসেসমেন্ট মেকানিজকে এসব ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে সামরিক অ্যাডভোকেট জেনারেল। ধারণা করা হচ্ছে, এসব ঘটনা যুদ্ধাপরাধের পর্যায়ে পড়তে পারে।
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ জানায়, গাজার শিশুরা ভয়াবহ পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। শুধু মে মাসেই ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সী ৫ হাজার ১১৯ শিশুকে গুরুতর অপুষ্টির চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা একাধিকবার ইসরায়েলকে ক্ষুধাকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন।
জিএইচএফ নামের এই নতুন মানবিক সহায়তা সংস্থা নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ১৫টি মানবাধিকার ও আইন সংস্থা এই প্রকল্প বন্ধের আহবান জানিয়েছে। তাদের মতে, এটি ‘স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহিতার সম্পূর্ণ অভাব’ এবং এটির কাঠামো অস্পষ্ট। এই সংস্থাগুলোর মতে, জিএইচএফের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন মানবিক কাঠামো থেকে একটি বেসরকারীকৃত ও সামরিকীকৃত বিপজ্জনক ব্যবস্থার দিকে সরে গেছে, যা মানুষের মর্যাদাহানি ঘটাচ্ছে এবং একই সঙ্গে মানুষকে জোরপূর্বক স্থানচ্যুত করছে। তারা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, এই ত্রাণ কার্যক্রম ফিলিস্তিনিদের সহায়তা করার কথা বলে বরং তাদের হত্যার ক্ষেত্র তৈরি করছে।
সূত্র : মিডিল ইস্ট আই